
স্বপ্ন দেখার অজানা সাত
ঘুমের মধ্যে আমাদের মস্তিষ্কের কর্মপ্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন ঘটে বলে
আমরা জানি। কিন্তু তখন ঠিক কী হয়, সে বিষয়ে আমাদের ধারণা খুবই ভাসা ভাসা।
এমনকি বিশেষজ্ঞরাও মানুষের ঘুমন্ত অবস্থার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কেবল
তত্ত্বই দিচ্ছেন। তবে স্বপ্ন দেখার বিভিন্ন দিক নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য
জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বহুদিন ধরেই ধারণা করা হচ্ছে, ঘুমের মধ্যে
আমাদের মস্তিষ্ক সারা দিনের কর্মকাণ্ড বা ঘটনাবলিকে বাছাই ও সংরক্ষণের জন্য
প্রক্রিয়াজাত করে। যত দিন যাচ্ছে, নতুন নানা গবেষণাও এই ধারণাকেই সমর্থন
জোগাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা মনোবিজ্ঞানী
রুবিন নাইমান মস্তিষ্ককে পরিপাকতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘রাতের
বেলায় মস্তিষ্ক প্রতীকী অর্থে (সারা দিনের সবকিছু) গিলে খায়, হজম করে এবং
তা থেকে নির্যাসটুকু নিংড়ে নিয়ে বাকিটুকু বের করে দেয়।’
রুবিন
নাইমান বলেন, ‘আর মস্তিষ্ক যা রেখে দেয় আমাদের স্মৃতিতে, চিন্তায়, তা-ই
থাকে এবং স্বপ্নকে এ প্রক্রিয়ার পরিপাক পদ্ধতি বলা যেতে পারে।’ আমরা ভাবি,
স্বপ্ন সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানি। হাফিংটন পোস্টের স্বপ্নসংক্রান্ত
প্রতিবেদন থেকে এখানে অজানা বা কম জানা কিছু তথ্য এবং কিছু ভুল ধারণা তুলে
ধরা হলো।
আমরা সারা রাত ধরে স্বপ্ন দেখি
অনেকেই জানেন যে, ঘুমের ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট’ বা ‘আরইএম’ পর্যায়ে আমরা
স্বপ্ন দেখি। কিন্তু চিকিত্সা মনোবিজ্ঞানী রুবিন নাইমান বলছেন, আসলে আমরা
সারা রাত ধরেই স্বপ্ন দেখতে থাকি। তিনি বলেন, এই পর্যায়টাতে আমরা আসলে
স্বপ্নের সঙ্গে অনেক বেশি একাত্ম থাকি। কিন্তু বাকি সময়টাতে আমরা তা ‘দেখতে
পাই না’ বলে ‘স্বপ্ন দেখা’ চলছে না, বিষয়টি এমন নয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে
‘আরইএম’ পর্যায় বাড়তে থাকে বলে আমরা রাতের তিন-ভাগের শেষ ভাগে বেশি স্বপ্ন
দেখি।
অ্যালার্মে জাগলে স্বপ্ন মনে থাকে না
ঘড়ি বা মুঠোফোনের অ্যালার্মে ধরফড় করে আকস্মিকভাবে জেগে উঠলে তার ঠিক
আগের মুহূর্তেই ঘুমের ঘোরে কী দেখছিলেন, কী ভাবছিলেন, তা ভুলে যাওয়ার
সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে এভাবে ঘুম থেকে জেগে উঠলে স্বপ্ন মনে থাকে না। এই
চিকিত্সা মনোবিজ্ঞানী বলেন, স্বপ্ন মনে রাখার ভালো উপায় হলো ঘুম থেকে ধীরে
ধীরে জেগে ওঠা, ধীরে ধীরে চোখ মেলা, বিছানায় গড়াগড়ি দেওয়া, তারপর ওঠা। তিনি
আরও বলেন, ‘স্বপ্নে কী দেখছেন তা ধরে রাখতে তার পেছনে ছুটবেন না। স্বপ্নের
পেছনে ছুটলে স্বপ্ন পালিয়ে যায়।’
স্বপ্ন মনে রাখা মস্তিষ্ক ভিন্নভাবে কাজ করে
২০১৪ সালের নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিতই তাঁদের দেখা স্বপ্ন
মনে রাখতে পারেন, তাদের মস্তিষ্কের বিশেষ একটি অংশে বিশেষ স্বতঃস্ফূর্ত
কর্মকাণ্ড ঘটে থাকে। যারা স্বপ্ন মনে রাখতে পারেন, তাঁদের মস্তিষ্কের
‘টেমপোরো-পারিয়েটাল জাংশন’ নামক একটি অংশে এটা ঘটে। শুধু ঘুমের মধ্যেই নয়,
জেগে থাকা অবস্থায়ও স্বপ্ন মনে রাখতে পারা আরা না-পারা এই দুই দল মানুষের
মস্তিষ্কের এই অংশের কর্মকাণ্ড কিছুটা আলাদা। ওই গবেষণা থেকে দেখা যায়,
যাঁরা ঘুমের মধ্যে হালকা শব্দেই জেগে ওঠেন বা নড়েচড়ে ওঠেন বা ঘুমের ঘোরেই
শব্দের প্রতিক্রিয়া দেখান, তাঁদের মধ্যে স্বপ্ন মনে রাখার হার বেশি।
স্বপ্নের মধ্যেও শরীর সাড়া দেয়
জেগে থাকা অবস্থায় আমাদের শরীর যেভাবে সাড়া দেয় বা প্রতিক্রিয়া করে, ঠিক
তেমনি স্বপ্নের মধ্যেও আমাদের শরীর সাড়া দিতে পারে। স্বপ্নে কিছু দেখে বা
শুনে কিংবা স্বপ্নে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় হঠাত্ ঘুম ভেঙে গেলে
আপনি জেগে উঠলেন। কিন্তু যার সঙ্গে কথা বলছিলেন, জেগে উঠে আপনি তাকে আর
পাচ্ছেন না। এ অবস্থাটা খুবই হতাশাজনক নিশ্চয়ই। রুবিন নাইমান বলছেন, জেগে
ওঠার পরও, চোখ মেলার পরও আমাদের শরীরে, মনে স্বপ্নের অবস্থাটা বা ওই ঘোরটা
থেকে যায় বলেই এমন হয়। আর বাস্তবের মতোই ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে উত্তেজিত হয়ে
পড়লে আপনার রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে বা অন্য কোনো আবেগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে
শরীরে অন্য কোনো উত্তেজনা তৈরি হতে পারে।
স্বপ্নেও ‘সময়ের হিসাব’ বাস্তবের মতোই
স্বপ্ন নিয়ে বহুল প্রচলিত ধারণা হলো, এক সেকেন্ডের কয়েক ভাগের এক ভাগ
সময়ে আমরা একটা লম্বা স্বপ্ন দেখে ফেলি বা স্বপ্ন খুবই স্বল্পকাল স্থায়ী
হয়। কিন্তু রুবিন নাইমান বলছেন, স্বপ্ন আসলে টানা ২০, ৩০ বা ৬০ মিনিটও
স্থায়ী হতে পারে। রাতের প্রথম দিককার সময়ে স্বপ্ন মাত্র কয়েক মিনিট স্থায়ী
হলেও রাত বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নের দৈর্ঘ্যও বাড়তে থাকে। কেননা
রাতের শেষভাগেই ঘুমের ‘আরইএম’ পর্যায়টা দীর্ঘ হয়।
‘দুঃস্বপ্ন’ মানেই কেবল ভীতির স্বপ্ন নয়
‘খারাপ স্বপ্ন’ বা ‘দুঃস্বপ্ন’ অনেক সময়ই ভয়ের স্বপ্ন হয়ে থাকে কিন্তু
এর ভেতরে অন্য গল্পও আছে। ২০১৪ সালের একটি নতুন গবেষণায় মনোবিজ্ঞানীরা
দেখতে পেয়েছেন যে, ‘দুঃস্বপ্ন’ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির ব্যর্থতা,
দুঃশ্চিন্তা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা, বিভ্রান্তি বা এমন অন্যান্য মানসিক অবস্থার
প্রতিফলন থেকে ঘটে থাকে। ১৩১ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের ওপর পরিচালিত
এক জরিপ থেকে এটা লক্ষ করা হয়। ওই গবেষকেরা আরও জানান, পুরুষেরা মারামারি
বা সংঘাত-সংঘর্ষের ‘দুঃস্বপ্ন’ বেশি দেখেন আর নারীরা ‘দুঃস্বপ্ন’ দেখেন
সম্পর্কের সংকট নিয়ে।
স্বপ্নে মরে গেলেও তা বলতে আপনি বেঁচে থাকেন
‘স্বপ্নে দেখলাম আমি মরে গেছি’—এটা স্বপ্ন দেখা নিয়ে একটা খুবই সাধারণ
অভিজ্ঞতা। অনেকেই বলে থাকেন, স্বপ্নে এমন মৃত্যু দেখাটা ভালো না। কিন্তু
মনোবিজ্ঞানী রুবিন নাইমান বলেন, এটা নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই। তিনি বরং
বলছেন, ‘স্বপ্নে মরার সুযোগ পেলে তা মিস করাটা ঠিক হবে না! যান ওই ঘটনাটার
অভিজ্ঞতাটা নিয়ে ফেলুন।’
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.