BREAKING NEWS

ads

Tuesday, September 5, 2017

আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন আমার

 

আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন আমার


নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা কজন—আমি, মা, বাবা, আমার ছোট আপু আর ভ্যানচালক ডাকুদা। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে ভ্যান চালাতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার তিনি। একটু ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আর আমার দৃষ্টি নদীর পাশের মরাকাটির খেলার মাঠের দিকে। আমার বন্ধুরা সবাই ক্রিকেট খেলছে সেখানে। আমারও তখন সেখানে থাকার কথা। দুদিন আগেই আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। অনেক আশা করেছিলাম, পরীক্ষা শেষে মুক্তবিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াব আর সারা দিন ক্রিকেট খেলব। অর্জুন আর রুবেলের শর্ট পিচ বলগুলো ঠিকমতো খেলতে পারি না। এই কয় মাসে অনুশীলন করে সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠব। কিন্তু সেটা আর হলো না।


আমি ঢাকায় চলে যাচ্ছি। ওখানে আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করব। আমার আপু-দুলাভাইয়ের বাসায় থেকে পড়ালেখা করতে হবে। ঢাকায় যাওয়ার কথা শুনে আমি প্রথমে খুব একটা অখুশি হইনি। প্রথমত আমি আমার কয়েক মাস বয়সী ভাগনি রিফাহকে খুব মিস করছিলাম। তার সঙ্গে খেলতে পারব সারা দিন, এই ভেবে খুব ভালো লাগছিল। আর ঢাকায় গেলে দুলাভাই আইসক্রিম কিনে খাওয়াবেন। আপু রান্না করবেন মজাদার নুডলস। এই সবকিছুর চেয়েও অনেক বড় একটা কারণ ছিল—নিজেকে ভালো একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা। এটা ১৭ এপ্রিল ২০০২ সালের কথা।

এর পাঁচ বছর আগে ক্লাস সিক্সে যখন দিনাজপুর জিলা স্কুলে পড়ার সুযোগ এসেছিল, তখনো বাবা-মাকে ছেড়ে শহরে থাকব না বলে অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম। এরপর আমার শিক্ষক প্রাণ কুমার স্যার যখন ভর্তি ফরমে আমার স্বাক্ষর নিতে এসেছিলেন, আমি বাড়ির পেছনের খেতে লুকিয়ে ছিলাম প্রায় কয়েক ঘণ্টা। যতক্ষণ স্যার আমাকে শহরে নিয়ে না যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি না দেন। এবার আর সে পথে না গিয়ে সুবোধ বালকের মতো ঢাকায় যাচ্ছি পড়তে। নদী পার হওয়ার পর ভ্যানচালক ডাকুদা আমাকে আর বাবাকে বললেন ভ্যানে উঠে পড়তে। শহরে যেতে সময় লাগবে। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার গালে অনেক আদর করে দিলেন আর বললেন ভালো করে পড়াশোনা করতে। আমি ভ্যানে উঠতেই মা কেঁদে ফেললেন। মার কান্না দেখে পাশ দিয়ে যাওয়া এক কাকা বললেন, মাস্টারনি এভাবে কাঁদলে ছেলের মন বসবে না তো ঢাকায়। আমিও মাকে বললাম, আপনি কাঁদলে আমি ঢাকায় যাব না। মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে কান্না ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন।

ঢাকায় এসে সময়ের স্রোতে শহুরে জীবনের বাস্তবতা টের পেলাম। চার দেয়ালের মাঝখানের বদ্ধ জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠি আমি। এরপর ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। এখানে এসে বুঝতে পারলাম নিজেকে ঝালিয়ে নেবার অফুরন্ত সুযোগ আমার সামনে। ধীরে ধীরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, আমি আমার পরিশ্রম দিয়ে বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করব। একদিন আমার গ্রামের স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্ন দেখাব উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকে ইংরেজি ক্লাসে ​ম্যাডাম আমাদের সবাইকে নিজেদের পরিচয় দিয়ে আমাদের স্বপ্ন কী বলতে বললেন। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে স্পষ্ট দৃঢ়তা নিয়ে বলে ফেললাম, আমি এই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হতে চাই। আমার কথা শুনে বন্ধুরা সবাই চোখাচোখি শুরু করল আর এই অধমের দুঃসাহস দেখে কেউ কেউ বিস্মিতও হলো। যা হোক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একদিন আমার স্বপ্নগুলোও ডানা মেলতে শুরু করল।
২০১২ সালে আমি আমার ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। এরপর সে বছরই পিএইচডি করতে জার্মান ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রে এসেছি। এখানে আসার পর আমি স্বপ্ন দেখি আমার দেশেও একদিন আমি অনেক বড় একটা রিসার্চ ল্যাব গড়ে তুলব। সেখানে গবেষণা হবে ক্যানসার জিনোম সিকুএন্সিং আর ফাংশনাল জিনোম নিয়ে। আমরা আমাদের নিজস্ব ক্যানসার তথ্যভান্ডার গড়ে তুলব। সেখানে কাজ করবে আমার দেশের সব তুখোড় খুদে বিজ্ঞানীরা।
এসব আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে নিজেকে ঝালিয়ে নিচ্ছি গত তিন বছর ধরে। এখন যখন আমার দেশে ফেরার সময় হয়েছে, সময় হয়েছে আমার স্বপ্নগুলোকে রাঙিয়ে তোলার, তখনই নানা অনিশ্চয়তা আর রূঢ় বাস্তবতা সামনে আসতে শুরু করেছে। বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে গবেষণা খাতে আমাদের অর্জন যৎসামান্য। মেধা আর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে আমরা এখনো সেভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারিনি। তার পরও স্বপ্নচারী মানুষের স্বপ্নযাত্রা থেমে থাকে না। এত সীমাবদ্ধতা পরও আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিনোমে রহস্য উন্মোচন করেছেন। কলেরা আর টাইফয়েড ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণায় আমরা অনেকের চেয়ে এগিয়ে। আমাদের দেশের ডিএনএ ল্যাব এখন অপরাধী শনাক্ত করতে আধুনিক কৌশল অবলম্বন করছে। সব সাফল্যের পেছনেই আছে অনেক বড় বড় স্বপ্ন আর স্বপ্ন দেখার জন্য স্বপ্নচারী আমার স্বপ্নও হয়তো একদিন পূর্ণ হবে। আগামী বিশ বছর পর হয়তো কার্জন হলের কোনো ল্যাবে বসে আমি আমার স্বপ্নের গল্প অন্যদের শোনাব আর তাঁর ফাঁকে এসে আমাদের ল্যাবের খুদে গবেষকেরা এসে বলবে, স্যার, আর্সেনিক দূষণের কারণে যেসব ক্যানসার হয়ে থাকে তাদের জিনোমে গবেষণা করে আমরা এমন একটি মিউটেশন পেয়েছি যেটা আর্সেনিকের জন্য হওয়া সকল ক্যানসারের মধ্যেই পাওয়া গেছে এবং সেগুলো ক্যানসার কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনে সাহায্য করে। আমি চোখে মুখে উত্তেজনার ভাব লুকিয়ে বলব, তাহলে আমরা কোষ বিভাজনে সেই প্রোটিনের ভূমিকা দেখতে চাই। কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ওখানকার বায়ো ইমেজ প্রসেসিং ল্যাবের সঙ্গে কথা বল। তারা কোষ বিভাজনের সময় বিভিন্ন প্রোটিনের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেন। এরপর খুদে গবেষকেরা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমি বিড়বিড় করে বলতে থাকব, ক্যানসার, এবার তোমার পাঁজর ভেঙ্গেই ছাড়ব। স্বপ্ন তো স্বপ্নই...সীমানা দিয়ে স্বপ্ন দেখার তো মানে হয় না।

Share this:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.

 
Back To Top
Copyright © 2014 আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। . Shared by Themes24x7